Home / রাজনীতি / খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টা: রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টা: রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন

গত বৃহস্পতিবার নিষিদ্ধ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পাতায় বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টায় একটি পোস্ট করা হয়, যেখানে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে তালাক দিতে চেয়েছেন।

দীর্ঘ কারাবাসের পর বর্তমানে অসুস্থ ৭৯ বছর বয়সী দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ৫৪ বছর পর এসেও একই দাবি বারবার উত্থাপন করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। 

বিতর্কের শুরু এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন খালেদা জিয়া তার দুই শিশু সন্তানসহ ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। 

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগপন্থি সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী দাবি করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ শেষে জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়াকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপে তা করা সম্ভব হয়নি।

এই দুটি পরস্পরবিরোধী আখ্যানই দেখায় যে কীভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ব্যক্তিগত ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বারবার ব্যবহার করা হয়। সাউথ এশিয়া জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই তালাকের গল্পকে অত্যন্ত অসম্ভাব্য আখ্যান (highly unlikely narrative) এবং রাজনৈতিক অপপ্রচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনটিতে বলা হয় জিয়া বা শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় এই ধরনের কোনো গল্প শোনা যায়নি। বরং এটি ১৯৯০-এর দশকে জিয়া পরিবারের সমালোচকদের দ্বারা প্রচারিত একটি অপমানজনক গল্প (denigrating story)।   

খালেদা জিয়াকে নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বয়ান

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন দাবির শুরুটা নব্বইয়ের দশকে হলেও ২০১৭ সালে এসে সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী আবার এই দাবিটি তুলে ধরেন। তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দাবি করেন যে, “মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হস্তক্ষেপে তিনি এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।”

এই বক্তব্যটি তিনি ২০১৭ সালে লন্ডনে তৎকালীন বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার নাদীম কাদিরের লেখা “মুক্তিযুদ্ধ: অজানা অধ্যায়” শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন । 

তার দাবির মূল সারমর্ম ছিল: যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খালেদা জিয়া বারবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এই অস্বীকৃতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে জেনারেল জিয়া তাকে বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষ হলে তিনি তাকে তালাক দেবেন। পরবর্তীতে, শেখ মুজিবের হস্তক্ষেপের কারণে জিয়া এই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন।

আবার ২০২০ সালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডট কমে প্রকাশিত একটি লেখায় দাবি করা হয়, “বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আতিথেয়তায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে ভারতে চলে যান আর খালেদা জিয়া দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে মানুষ যখন ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় নিচ্ছিল তখন খালেদা কেন ঢাকাকে নিরাপদ মনে করল?”

সেই লেখায় আরও দাবি করা হয় যে, “জিয়াউর রহমান বেগম জিয়াকে নিয়ে যেতে সাত মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের সঙ্গে যেতে অস্বীকৃতি জানান। যে সাত মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছয়জনই পাকিস্তানি হানাদারের হাতে প্রাণ দেন।”

বিএনপি কী বলে?

আওয়ামী লীগ যখন খালেদা জিয়াকে দেশে যুদ্ধ চলাকালীন “বিরোধীদের অতিথি” প্রমাণে ব্যস্ত সেই সময় সময় আবার বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করা হয়।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বরাতে বলা হয়, “বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হবেন না, তো কে মুক্তিযোদ্ধা হবেন? যারা পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, আর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল তারা মুক্তিযোদ্ধা হবে? বেগম জিয়া অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা, তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। তাঁর যোগ্যতায় তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।”

তবে, এই দাবিগুলো সাধারণত রাজনৈতিক বক্তব্য বা রাজনৈতিক কলামের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, যার কোনো নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। যেমনটা নেই খালেদা জিয়াকে জিয়াউর রহমান তালাক দিতে চেয়েছিলো এমন দাবির ক্ষেত্রেও। 

বরং যুদ্ধ শেষে যখন জিয়া ও খালেদা পুনরায় মিলিত হন, তখন তাদের মধ্যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কোনো অভাব দেখা যায়নি বলে জানানো হয়েছে সাউথ এশিয়া জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে, যার লেখক নিজেকে জিয়া পরিবারের পরিচিত বলে দাবি করেছেন এবং লেখার শুরুটাই করেছেন খালেদা জিয়ার সাথে তার প্রথম পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে। 

রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও বর্তমান বাস্তবতা

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলা শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সাধারণ ঘটনা। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা এবং এমএ ওয়াজেদ মিয়ার ব্যক্তিগত জীবনকে পাবলিক গসিপে পরিণত করার চেষ্টা দেশের এই শিষ্টাচারবিহীন রাজনৈতিক কালচারের একটি অংশ। 

সাম্প্রতিক সময়ে একই ধরণের আচরণ দেখা যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারাকে নিয়েও। ইতোমধ্যে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার ছবিকে বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে। 

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে আজ থেকে ৫৪ বছর আগে। পাঁচ যুগেরও বেশি সময় পর আজ ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা এবং দীর্ঘদিন কারাবাসের কারণে যখন রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে রয়েছেন, তখন এই ধরনের পুরনো বিতর্কের পুনরুত্থান রাজনৈতিকভাবে অসংবেদনশীল এবং অপ্রয়োজনীয় আচরণের বহিঃপ্রকাশ। 

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের জন্য তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ধরনের পুরনো দাবি প্রকাশ করাটা একটা রাজনৈতিক হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখা যায়। 

সাউথ এশিয়া জার্নালে ২০২০ সালে প্রকাশিত লেখায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে এই ধরনের গল্প আওয়ামী লীগের কাজ (Awami doing) হতে পারে, যার লক্ষ্য ছিল মুজিবের মহত্ত্ব (Mujib’s magnanimity) তুলে ধরা এবং জিয়া পরিবারকে হেয় করা।

সর্বোপরি এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়, যেখানে প্রতিপক্ষকে ছোট করার জন্য ঐতিহাসিক তথ্যকে বারবার বিকৃত করার পাশাপাশি নারী রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিজীবন নিয়েও বিতর্কিত প্রশ্ন তোলা হয়। 

এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক দাবি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তে বিভাজন ও তিক্ততা বাড়ায়। দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে রাষ্ট্রের জনগণ প্রত্যাশা করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচার; যা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য খুবই প্রয়োজন।

Tagged: