Home / আন্তর্জাতিক / অর্কার আক্রমণে জেসিকা র‍্যাডক্লিফের মৃত্যু দাবিতে ভুয়া গল্প, ভিডিও প্রচার

অর্কার আক্রমণে জেসিকা র‍্যাডক্লিফের মৃত্যু দাবিতে ভুয়া গল্প, ভিডিও প্রচার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাম্প্রতিক সময়ে “জেসিকা যাকে সন্তান হিসেবে পাললো, সেই অর্কাই তাকে খেয়ে ফেললো” এমন দাবিতে ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। ভিডিও দেখা যায়, পার্কের মধ্যে খেলা দেখানো অবস্থায় অর্কা ট্রেইনার জেসিকা উপর আক্রমণ করে।‌

এই দাবিতে ফেসবুকে পোস্ট আছে এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

এই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত এক কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ভিডিওটি প্রায় ৬ হাজার বার শেয়ার এবং তাতে ১ লাখ সত্তর হাজারের বেশি প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। 

অনুসন্ধানের শুরুতেই আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে ইনসাইড রিউমারস। ভিডিও পর্যবেক্ষণে এতে কিছু অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। 

প্রচারিত ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে জেসিকা র‍্যাডক্লিফ নামের এক মহিলা মেরিন ট্রেইনার প্যাসিফিক ব্লু মেরিন পার্ককে অর্কাকে নিয়ে পারফরম্যান্স দিচ্ছেন। ঠিক মুহূর্তে ওই অর্কা তাকে আক্রমণ করে পানির নিচে নিয়ে যায়। এরপর অর্কার আক্রমণে জেসিকার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয়। যা মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

তবে ভিডিও টির প্রথমেই লক্ষণীয় বিষয় হলো ট্রেইনার ও অর্কার গতিবিধি একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পাশাপাশি অর্কার আক্রমণে জেসিকার প্রতিক্রিয়া অনুপস্থিত।

দ্বিতীয়ত ভিডিওর এক জায়গায় জেসিকাকে বাঁচাতে আসা অন্যান্য ট্রেইনার শরীরের ভঙ্গি, দৌড়াদৌড়ি, ভিডিওতে ব্যবহৃত ছবি ও ভয়েস কোনকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়নি। এছাড়া এসময় উপস্থিত দর্শকদের প্রতিক্রিয়া এবং পরিপার্শ্বিক যে দৃশ্যও দেখানো হয়েছে যা বাস্তব না, বরং অনেকটা অ্যানিমেটেড ফ্রেমের মতো মনে হয়। 

সবমিলিয়ে দৃশ্যের গতিশীলতা এবং উপস্থিত দর্শক, অন্যান্য ট্রেইনার, অর্কা ও জেসিকার নড়াচড়ার সহ সবকিছুর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে ধারনা করা যায় এটি একটি এআই নির্মিত ভিডিও।

এছাড়া অনুসন্ধানে জেসিকা র‍্যাডক্লিফ নামের কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায়নি এবং অস্তিত্ব মেলেনি প্যাসিফিক ব্লু মেরিন নামের কোন পার্কেরও। ঘটনাটি নিয়ে দেশী বিদেশী কোনো গণমাধ্যমের সত্যতা না মিললেও প্রচারিত ভিডিও টি যে ভুয়া তা নিয়ে দ্য ডেইলি ইনকিলাব, কালবেলা, এনডিটিভি, বিজনেস টুডে, দ্য ইকোনমিস্ট টাইম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে ইনসাইড রিউমারস এআই কন্টেন্ট শনাক্তকারী প্লাটফর্ম ক্যানটিলাক্সের (cantilux) এর সাহায্য নেয়। ক্যানটিলাক্সের পরীক্ষায় জানানো হয় যে এই ভিডিওটি এআই দিয়ে তৈরি হবার সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। 

মিথ্যা গল্পের পেছনের বাস্তবতা:

এমন একটি ভিডিও কিভাবে হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলো বা এর পিছনের বাস্তবতাই বা কি? এ বিষয়ে রিউমার ইনসাইডের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ভিডিওটির অনেকাংশে ২০১০ সালে সি-ওয়াল্ড এ ঘটা এক বাস্তব ঘটনার উপর তৈরিকৃত। সে সময় অর্কার আক্রমণে ডন ব্রানশো নামের এক অভিজ্ঞ ট্রেইনারের মৃত্যু হয়। আর এই ঘটনার আদলে সম্প্রতি মিথ্যা গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। আর এমন একটা হৃদয়বিদারক ভুয়া গল্পে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেছে চারদিকে।

জানা যায়, ডন ব্রানশো ছিলেন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে অবস্থিত সি-ওয়ার্ল্ডের একজন সিনিয়র ট্রেইনার। তিনি নিয়মিত এসব প্রাণীর নিয়ে কাজ করতেন, যার মধ্যে টিলিকাম নামের এক কিলার হোয়েলও (ডলফিন পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য যারা অর্কা নামেও পরিচিত) ছিল। এদের দেখভাল করা, খাবার দেয়া এবং ট্রেনিং শেখানোই ছিল ডন ব্রানশোর কাজ।

তবে ২০১০ সালের একদিন পরিস্থিতি পাল্টে যায়। শান্তশিষ্ট আর ব্রানশোর প্রতি অনুগত টিলিকম দর্শকদের সামনে পারফরম্যান্সের এক পর্যায়ে হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্দিদশায় থাকা টিলিকাম তার ট্রেইনারকে আক্রমণ করে বসে এবং তাকে টেনে নিয়ে যায় পানির নিচে। এরপর তাকে দীর্ঘসময় আটকে রেখে। শেষ পর্যন্ত দর্শক ও অন্যান্য ট্রেইনারদের সামনে ব্রানশো ডুবে মারা যায়। এ নিয়ে অনলাইন ভিত্তিক প্রকাশিত গণমাধ্যম ভিটির প্রকাশিত এক ভিডিও পাওয়া গেছে।

ব্রানশোর আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয় — ডুবে যাওয়া এবং আঘাত আঘাতজনিত ক্ষত। আক্রমণে তার একটি হাত কাঁধের সংযোগস্থান থেকে ছিঁড়ে যায়, এবং টিলিকাম তার মাথার চুল ও স্ক্যাল্প ছিঁড়ে ফেলার পর তা পুলের তলায় পাওয়া যায়।

সেই সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরিকৃত একটি ভুয়া গল্প এখন আবার প্রচার করা হচ্ছে। 

অর্কা বা কিলার হিয়েলরা কি সত্যিই এমন আক্রমণাত্মক? 

এ বিষয়ে জানা যায়, অর্কা বা কিলার হোয়েল আসলে ডলফিন পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য, যদিও নামের কারণে অনেকেই একে তিমি মনে করেন। 

এরা পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে অন্যতম। শুধু শিকার কৌশলই নয়, অর্কা খেলা করে, একে অপরকে শেখায়, এমনকি অন্য প্রাণীর সাথেও যোগাযোগ করে। বন্য পরিবেশে মানুষের ওপর আক্রমণ খুবই বিরল হলেও বন্দিদশায় তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। ২০১০ সালে সি ওয়ার্ল্ডে ঘটে যাওয়া “টিলিকাম” নামের অর্কার ঘটনায় ট্রেইনার ডন ব্র্যাঞ্চুর মৃত্যু এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। 

সার্বিক দিক বিবেচনায় এটি স্পস্ট যে, ট্রেইনার জেসিকার উপর অর্কার আক্রমণে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি বাস্তব নয়। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং এআই দিয়ে তৈরি।

Tagged: