মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের টকশোতে বৃহস্পতিবার হাজির ছিলেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী৷ আলোচনার একপর্যায়ে খালেদ জানান যে গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্ক সফরকালে তিনি তার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তিনি সাক্ষাৎকার দেননি৷
তিনি আক্ষেপের সুরে একথাও বলেন যে তিনি ছাড়া সবাইকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রফেসর ইউনূস৷
প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াচ্ছেন কথাটা সঠিক নয়৷ এখন অবধি তিনি কিছু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বটে কিন্তু এখনো অনেকে তার সাক্ষাৎকার চেয়েও পাননি৷ এবং এই না পাওয়ার তালিকায় যারা আছেন তাদের মধ্যেও দেশিবিদেশি অনেক প্রথিতযশা, জ্যেষ্ঠ, জনপ্রিয় সাংবাদিক, সম্পাদক রয়েছেন৷ সুতরাং অধ্যাপক ইউনূস শুধু খালেদ মুহিউদ্দীনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন না – এই তথ্যটি ভুল৷
একটু অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, প্রফেসর ইউনূস যখন প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন না এবং খালেদ মুহিউদ্দীন যখন জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলার প্রধান ছিলেন তখন তাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন প্রফেসর ইউনূস৷ ফলে সুনির্দিষ্টভাবে খালেদ মুহিউদ্দীনকে সাক্ষাৎকার না দেয়ার কোনো কারণ তার কাছে থাকার কথা নয়৷ বরং প্রফেসর ইউনূস চাটুকারিতার চেয়ে ভালো গবেষণা করা যেকোনো যৌক্তিক প্রশ্ন মোকাবিলা করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন৷ তিনি সম্ভবত একমাত্র বাংলাদেশি যার সাক্ষাৎকার পৃথিবীর প্রভাবশালী প্রায় সব সাংবাদিক নিয়েছেন৷
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রফেসর ইউনূস যেসব সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেগুলো মূলত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি সংবাদমাধ্যম বা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম৷ বাংলাদেশের কয়েকটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমকেও তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন৷
ফলে তার দেয়া এসব সাক্ষাৎকার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্যক্তিনির্ভর কোনো গণমাধ্যমকে তিনি সাক্ষাৎকার দেননি৷ মূলধারার সংবাদমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না এরকম সংবাদমাধ্যমকেও সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়নি অধ্যাপক ইউনূসকে৷ প্রতিদিন যে পরিমান ব্যস্ততা ৮৫ বছর বয়সি এই নোবেল জয়ীর থাকে, তাতে সবাইকে সাক্ষাৎকার দেয়া সম্ভবও নয়৷
প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকার না পাওয়ায় খালেদ যে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে তার সমালোচনা শুরু করেছেন তার আরো কিছু সাম্প্রতিক নজির রয়েছে৷ তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত আরেকটি অনুষ্ঠানে এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী (সিনিয়র সচিব) লামিয়া মোর্শেদ এবং উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীরকে আক্রমণ করেছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে৷
মাঝে মাঝে তিনি অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের’ অভিযোগ আনেন কারণ গ্রামীণ নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে বলে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি যে তথ্যটি উল্লেখ করেন না তাহচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল বিগত সরকারের সময় এবং সেই সরকার শুধুমাত্র প্রফেসর ইউনূসের প্রতি বিরাগভাজন ছিল বলে এসব আবেদন অনুমোদন না করে ফেলে রেখেছিল৷ বাতিলও করেনি৷
প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের সময় যেসব মামলা করা হয়েছিল, সেসব মামলা যে খুবই দুর্বল এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ছিল, সেকথা খালেদ মুহিউদ্দীনের অজানা নয়৷ শেখ হাসিনার পতনের পর অধ্যাপক ইউনূসের বদলে অন্য যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসলেও এসব মামলা টিকতো না৷ কিন্তু খালেদ তার আলোচনায় সেই দিকটা তোলেন না৷ বরং এটাকেও প্রফেসর ইউনূসের সমালোচনার এক উপলক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছেন তিনি৷
বর্তমানে নিউইয়র্কের এক অখ্যাত বাংলা পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন৷ তিনি পত্রিকাটিতে যোগ দেয়ার পরও সেই পত্রিকার সংবাদের গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ পরিবর্তন শুধু তিনি সেখানে যোগ দেয়ার পর নতুন গড়া ইউটিউব চ্যানেলটি৷ এটা খালেদ মুহিউদ্দীন বুঝতে না চাইলেও এমন এক বাস্তবতা যা ঢাকায় অনেকেই বিবেচনায় নিয়ে থাকেন৷
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরকে কেন্দ্র করে আরেক সাংবাদিক তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ উগরাতে শুরু করেছেন৷ তার নাম জুলকারনাইন সায়ের খান৷ লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা কিছু প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও সায়েরকে সেখানে দেখা যায়নি৷ সেই হতাশা থেকে সায়েরও প্রধান উপদেষ্টার পেছনে লেগে আছেন নিরলস৷ ঢাকার বাতাসে এটাও শোনা যায় যে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাসে বিশেষ পদে বসতে আগ্রহী তিনি৷ কিন্তু সরকারের তাতে সায় নেই৷
একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকতেই পারে৷ কিন্তু প্রফেশনাল সাংবাদিকরা তাদের প্রফেশনাল প্ল্যাটফর্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষোভ উগড়াতে ব্যবহার করলে সেটা গ্রহণযোগ্যতা এবং নিরপেক্ষতা হারায়৷ হতাশার হলেও দেখা যাচ্ছে প্রবাসী এই দুই সাংবাদিকই অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যসমৃদ্ধ সুনির্দিষ্ট সমালোচনার বদলে গুজবভিত্তিক কুৎসা রটানোর দিকে মনোযোগী হয়েছেন৷