সম্প্রতি দেশীয় গণমাধ্যম দৈনিক কালবেলা “Kalbela World” নামে নিজেদের ইউটিউব (আর্কাইভ) ও ফেসবুক পাতায় ইরাকের কুর্দিস্তানের অধিবাসী মালা আলি কুর্দিস্তানি নামের স্ব-স্বীকৃত এক চিকিৎসককে নিয়ে ১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও (আর্কাইভ) প্রচার করেছে৷
ভিডিওতে দাবি করা হয়,“তিনি বাক-প্রতিবন্ধীর মুখে হাত রেখে পবিত্র কুরআন তেলওয়াত করছেন, সাথে সাথে কথা বলতে পারছে সে৷ কানে শুনতে পায় না এমন ব্যক্তির কানের কাছে হাত রেখে কুরআন তেলওয়াত করছেন, সাথে সাথে কানে শুনতে পাচ্ছে সে। জানা গেছে ওই ব্যক্তির নাম মালা আলি কুর্দিস্তানি৷ তিনি ইরাকের কুর্দিস্তানের ইরবিলের বিখ্যাত আলেম। তিনি সেখানে নবীক ক্লিনিক নামে একটি ক্লিনিক পরিচালনা করেন৷”
“Kalbela World” নামের ফেসবুক পাতায় প্রচারিত এই ভিডিওটি এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মিলিয়নের বেশিবার দেখা হয়েছে, শেয়ার হয়েছে ১০ হাজার বার৷ ইউটিউবে একই ভিডিও দেখেছে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ৷
ইনসাইড রিউমারসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালা আলি নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে দাবি করলেও ভুয়া চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে গ্রেফতার হয়েছেন৷ এমনকি নিজ দেশ ইরাকের কুর্দিস্তান প্রদেশ থেকেও তিনি বিতাড়িত হয়েছেন৷
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ব্যক্তির ফেসবুক পাতা পর্যবেক্ষণ করেছে ইনসাইড রিউমারস। তিনি নিজের ফেসবুক পাতাটির নাম দিয়েছেন “Dr.Mala Ali Kurdistani”। এই নামেই তিনি পরিচিত। পাতার ইংরেজি বায়োর বাংলা করলে হয়, “আমার নাম ড. আলি মাহমুদ হাসান। আমি ২৮ বছর ধরে ভেষজ চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ।”
তবে কুর্দিস্তানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তার আসল নাম মোল্লাহ আলি কালাক।
তার ইউটিউব চ্যানেলও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে ইনসাইড রিউমারস। ৩.৫৫ মিলিয়ন অনুসারীসমৃদ্ধ চ্যানেলে আরবি ভাষায় প্রচারিত প্রায় ৫ হাজার ভিডিও রয়েছে৷ তার প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে দাবি করা হয়, তিনি কোরআনের আয়াত ব্যবহার করে অসুস্থ, জ্বিনে আক্রান্ত এবং অক্ষম মানুষদের সুস্থ করে তোলেন।
কুর্দিস্থানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম রুদাউ ইংলিশ এক প্রতিবেদনে জানায়, তার এই কর্মকাণ্ড শুরু হয় ইরাকের কুর্দিস্তান প্রদেশের ইরবিল শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে তার নিজ গ্রাম কালাক থেকে। সেখানে তিনি একটি হিলিং সেন্টার বা রোগ নিরাময় কেন্দ্র খোলেন। দাবি করা হয় তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসাও করতে পারেন। এই চিকিৎসায় তিনি উটের মুত্রকে উটের দুধের সঙ্গে মিলিয়ে রোগীকে খাওয়াতেন। চিকিৎসার জন্য তিনি রোগীকে চাবুকও মারতেন।
কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ওই প্রতিবেদনে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম রুদাউ ইংলিশ-কে জানায়, সরকার বারবার তার নিরাময় কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিয়েছিল। তার বেআইনি চিকিৎসা কার্যক্রমের কারণে কর্মকর্তারা তাকে একাধিকবার গ্রেফতার করে ও আদালতে হাজিরার নোটিশ দিয়েছিলেন। এক নারীকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগেও তাকে গ্রেফতার করা হয়।
কুর্দিস্তানে তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের পর ২০২০ সালে তিনি কুর্দিস্তান ছেড়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমান৷ সৌদি আরবের মদিনায় ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি একটি ভিডিও পোস্ট করেন মালা আলি, সেখানে দাবি করেন যে তিনি সৌদি আরবের পবিত্র শহর মদিনায় এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে সুস্থ করেছেন; যিনি কিনা দশ বছর ধরে অন্ধ ছিলেন!
ভিডিওতে দেখা যায়, মালা আলি নিজের জিহ্বা দিয়ে তর্জনী আঙুল চেটে তা ওই ব্যক্তির দুই চোখে ছোঁয়ান। এরপর কোরআনের একটি সূরা পাঠ করেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বৃদ্ধ ব্যক্তি দাবি করেন যে, তার দৃষ্টি ফিরে এসেছে।
কিন্তু ভিডিও প্রকাশের চারদিন পর সৌদির স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত একটি ভাইরাল ক্লিপে সেই একই ব্যক্তি (সৌদি পুলিশের তথ্যানুসারে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত) মালা আলিকে “মিথ্যাবাদী” বলে অভিহিত করেন। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে রুদাউ।
ভিডিওটি একটি মসজিদে ধারণ করা হয়- যেখানে বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার সাথে বসে থাকা কেউ জিজ্ঞেস করেন, তিনি কীভাবে সুস্থ হয়েছেন? জবাবে তিনি বলেন, “আমি তাকে (মালা আলিকে) বলিনি যে আমি অন্ধ… আল্লাহর কসম, সে একজন মিথ্যাবাদী।”
ভিডিও প্রকাশের পরপরই মালা আলিকে গ্রেফতার করা হয়। মদিনা পুলিশের বরাতে কুর্দিস্তানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম রুদাউ এক প্রতিবেদনে জানায়, মালা আলিকে গ্রেফতার করা হয়েছে “পাকিস্তানি লোক আনা” এবং “তাদের সুস্থ করার দাবি” করার অভিযোগে। এখানে পাকিস্তানি বলতে ভিডিওতে দেখানো বৃদ্ধের কথাই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ বলছে, তিনি সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য পাকিস্তান থেকে ওই বৃদ্ধকে নিয়ে এসেছেন।
সৌদিতে গ্রেফতারের পর জামিন পেলে তিনি সেখান থেকেও চলে যান এবং অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও পোস্ট করেন এবং তাতে দাবি করেন, “আমি যে কাজ করি সেটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- আমাদের কুর্দিস্তানে বিজ্ঞানকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমার মতো এমন অনেক আলেম আছেন কিন্তু মুসলিম উম্মাহ আমাদের কোনো মূল্যায়ন করে না।”
রুদাউ-এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি থেকে তিনি চলে যান তুরস্কে। এরপর ইস্তাম্বুলে একটি ক্লিনিক খোলেন। সেখানেও হাজার হাজার মানুষ তার কাছে যান। কিন্তু তার কাজে বাধ সাধে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা অভিযোগ আনেন, বিনা লাইসেন্সে তিনি বেআইনি কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
তুরস্কের অনলাইন ভিত্তিক গণমাধ্যম “Duvar English” এক প্রতিবেদনে জানায়, তার ক্লিনিকে তুর্কি পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করে এবং ক্লিনিক সিলগালা করে দেয়৷ তবে ওই সময় মালা আলি সেখানে ছিলেন না।
২০২১ সালের নভেম্বরে মালা আলি পাকিস্তানে যান। তিনি দেশটির যেখানেই গেছেন সেখানেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। শুধু সাধারণ মানুষই নন, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদরা এবং বেশ কয়েকজন ধর্মীয় নেতা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি তার সঙ্গে কোলাকুলি করেন এবং খুবই হৃদ্যতার সঙ্গে বৈঠক করেন। দেশটির জাতীয় সংসদের স্পিকার আসাদ কায়সার মালা আলিকে পাকিস্তানি টুপি পরিয়ে স্বাগত জানান।
মালা আলি কুর্দিস্তানিকে নিয়ে পাকিস্তানে এত বেশি মাতামাতি নিয়ে পাকিস্তানের ডন নিউজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। ওই ভিডিওতে স্পিকারের এই কাণ্ডের বিষয়ে ডন নিউজের উপস্থাপক বলেন, “যে ব্যক্তি সবাইকে টুপি পরিয়ে বেড়াচ্ছেন (প্রতারিত করছেন অর্থে) তাকেই টুপি পরিয়ে দিলেন স্পিকার!”
তিনি আরও বলেন, “মালা আলি বিভিন্ন মুসলিম দেশেও গেছেন। তবে পাকিস্তানে যেভাবে সবার চোখে ধুলে দিয়েছেন সেটা আর কোথাও পারেননি।”
২০২৩ সালে পর্যটক ভিসায় মালদ্বীপে গিয়ে সেখানেও এক বাক-প্রতিবন্ধীকে সুস্থ করে তুলেছিলেন বলে মালা আলি দাবি করেন৷ মালদ্বীপের স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য টাইমস অব আদ্দু’ এক প্রতিবেদনে জানায়, মালদ্বীপের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় এ নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে কোনো সত্যতা পায়নি৷
এর আগে ২০১৭ সালে মালা আলি অদ্ভুত একটি কথা বলে বিতর্কের সৃষ্টি করেন। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিনে ধরেছে।” তিনি ট্রাম্পকে তার পায়ের তলায় মেরে সুস্থ করতে পারেন।
সুতরাং, সার্বিক অনুসন্ধানে জানা যায়, মালা আলি নিজেকে চিকিৎসক দাবি করে অনেককে সুস্থ করা কথা বললেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে এর কোনো সত্যতা পায়নি ইনসাইড রিউমারস। বরং তার বিরুদ্ধে একাধিক দেশে ভুয়া চিকিৎসার অভিযোগ রয়েছে৷